বরুড়া উপজেলার গৃহবধু ইয়াসমিন হত্যার রহস্য উদঘাটন


admin. প্রকাশের সময় : মার্চ ২৯, ২০২২, ৩:৪২ অপরাহ্ণ /
বরুড়া উপজেলার গৃহবধু ইয়াসমিন হত্যার রহস্য উদঘাটন

॥ স্টাফ রিপোর্টার ॥
কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার ডেউয়াতলী এলাকায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ইয়াসমিন আক্তার(২২) নামে একজন গৃহবধূ গত ১১ মার্চ আগুনে পুড়ে মারা যায়। এঘটনার পরদিন গৃহবধুর ভাই মোঃ রাকিব হোসেন বাদী হয়ে বরুড়া থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করেন। ঘটনাটি কুমিল্লায় ব্যপক চাঞ্চল্যর সৃষ্টি হয়। ঘটনাটি অত্যন্ত নির্মম ও হৃদয় বিদারক হওয়ায় র‌্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লা এর গোয়েন্দা দল ঘটনার সঠিক তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য কাজ শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিকভাবে ভিকটিমের স্বামী রেজাউল করিমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। পরবর্তীতে রেজাউলের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাদের দেওয়া তথ্য অসামঞ্জস্য মনে হলে র‌্যাব এর সন্দেহ আরও বেড়ে যায়।
র‌্যাব এর গোয়েন্দা দল এঘটনার গভীরভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা নজরদারীর সূত্র ধরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২৮ মার্চ রাতে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লার কোতয়ালী থানাধীন ইপিজেড এলাকা থেকে আতœগোপনে থাকা অবস্থায় রেজাউল করিম(৩০)কে আটক করা হয়। সে বরুড়া উপজেলার ডেউয়াতুলি গ্রামের আলতাফ হোসেনের ছেলে।
নিহত গৃহবধুর মা, ভাই এবং আত্মীয় স্বজনের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, ২০১৭ সালের শুরুতে রেজাউল করিম ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তার এর বাড়ির (চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ থানার ডিংগাভাঙ্গা) পাশে ‘‘পেইজ” নামক একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকুরী করতো। সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার সুবাদে রেজাউল করিমের সাথে ইয়াসমিন আক্তারের মা বেবী আক্তারের পরিচয় হয়। সেই সুবাদে রেজাউল করিম ঋণের কিস্তির টাকা নিতে ভিকটিমের বাড়িতে আসা যাওয়া করতো। আসা যাওয়ার একপর্যায়ে ইয়াসমিন আক্তার এর সাথে রেজাউল করিমের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। প্রেমের সম্পর্কটি এলাকায় জানাজানি হলে ইয়াসমিনের পূর্বের স্বামী আনোয়ার হোসেনের সাথে তালাক হয়ে যায়। তাই খুব অল্প পরিসরে তাৎক্ষনিকভাবে কোন প্রকার কাবিন ও ইসলামিক প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই রেজাউল করিম ইয়াসমিন আক্তারকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে রেজাউল করিম তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে নেয়ার কথা বলে আশ্বস্ত করে তড়িঘড়ি করে মালদ্বীপ চলে যায়। রেজাউল মালদ্বীপ গিয়ে স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলেও বিভিন্নভাবে রেজাউলকে দেশে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করতে চাপ প্রয়োগ করে। পরবর্তীতে গত ০৭ জানুয়ারি রেজাউল মালদ্বীপ থেকে দেশে ফিরে আসে এবং অনেকটা বাধ্য হয়ে পরিবারের অমতে গত ১০ জানুয়ারি ভিকটিম ইয়াসমিন আক্তার, পিতা-মৃত আক্তার হোসেন, মাতা-বেবী আক্তার, সাং-ডিংগাভাঙ্গা, থানা-মতলব দক্ষিণ, জেলা-চাঁদপুর এর সাথে রেজাউল করিম অনেকটা বাধ্য হয়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিবাহের পর রেজাউল করিম স্ত্রী ইয়াসমীনকে তার বাড়ি বরুড়া থানাধীন ডেউয়াতলী গ্রামে নিয়ে আসে। অর্থনৈতিভাবে অসচ্ছল জেনেও রেজাউল যৌতুকের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং এতে পারিবারিক কলহ দেখা দেয়। একদিকে রেজাউলের পরিবার অপর দিকে যৌতুকের চাপের কারণে তাদের পারিবারিক কলহ চরমে উঠে। সর্বশেষ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সামাজের ব্যক্তিবর্গ সালিশে বসে বিষয়টি সমাধান করেন এবং তাদেরকে একত্রে থাকতে বলেন। সালিশে রেজাউল বিষয়টি মেনে নিয়ে একত্রে থাকতে শুরু করে কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।
গ্রেফতারকৃত রেজাউল করিমের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, গত ১০ মার্চ বিকেলে রেজাউলের সাথে তার স্ত্রী ইয়াসমিন আক্তারের বিভিন্ন বিষয়ে কথা কাটাকাটি হলে রেজাউল তাকে চড়থাপ্পড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। চড়থাপ্পড় মারলে রেজাউলের নখের আঁচড়ে গালের নিচে আঁচর পড়ে। এরপর আবার সন্ধ্যা ৭টায় তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হলে রেজাউলের বাবা মা এসে থামায়। পওে রেজাউলের বাবা মা ঘুমিয়ে গেলে পুনরায় তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে রেজাউল ক্ষীপ্ত হয়ে স্ত্রী ইয়াসমিন বেগমের গলা চেপে ধরলে স্ত্রী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তার কিছুক্ষণ পরে রেজাউল ভিকটিমের গায়ে হাত দিয়ে দেখে ভিকটিমের শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। পরবর্তীতে সে বুজতে পারে তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই। এমতাবস্থায় সে সারারাত চিন্তা করতে থাকে তার স্ত্রীর মৃত্যুর বিষয়টি পরিবার ও লোকমুখে জানাজানি হলে সে কি জবাব দিবে চিন্তা ভাবনার একপর্যায়ে ১১ মার্চ আনুমানিক ভোর ০৫:০০ ঘটিকায় সে তার স্ত্রী ভিকটিম মৃত ইয়াসমিন আক্তারের সারা শরীরে তার ঘরে থাকা কেরোসিন তৈল ঢেলে আগুন লাগিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের ন্যায় ফজরের নামাজ পড়তে চলে যায় এবং নামাজ শেষে স্থানীয় লোক জনের আগুন লাগার বিষয়ে কোন আওয়াজ না পাওয়ায় সে পারিবারিক কবরস্থান জিয়ারতের উদ্দেশ্যে চলে যায়। ইতিমধ্যে রেজাউল কবরস্থানে থাকা অবস্থায় স্থানীয় লোক জনের মাধ্যমে আগুন লাগার বিষয়ে জানতে পারে এবং অতিদ্রুত তার বাড়িতে গমন করে। স্থানীয়দের আগুন নিভানোর সময় রেজাউল ও তাদের সাথে আগুন নিভানোর ভান করতে থাকে এবং বলতে থাকে ঘরের ভিতর তার স্ত্রী ও তার বিদেশ যাওয়ার সকল কাগজপত্রসহ টাকা পয়সা রয়েছে। বিষয়টি বলতে বলতে রেজাউল জ্ঞান হারানোর ভান ধরে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয় এবং তার স্ত্রীর জানাজা শেষে হাসপাতাল হতে সে আত্মগোপনে চলে যায়। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সে দ্রুত দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করে।

শেয়ার করুন