রাসেল আহমেদ,পূর্বাচল ঘুরেঃ তুমি যদি যাও-দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে, শিম আর শিম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেই খানে। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের নেমন্ত্রণ কবিতার পংক্তিগুলোর মতোই রূপগঞ্জের পূর্বাচলে হাত বাড়ালে মুঠি ভরে শিম মিলে। শিশির ভেজা শিমের ক্ষেত। লকলকে শিমের ডগায়, লাল-সাদা ফুলের পাপড়িতে চিকচিক করছে শিশির বিন্দু। ক্ষেতে শিম। জমির আলে শিম। খালের পাড়ে শিম। বাদ যায়নি তিনশ’ ফুট সড়কের দ’ুপাশও। বলা যায় শিমের রাজ্য পূর্বাচল। চলতি মৌসুমে রূপগঞ্জ উপজেলার শুধু পূর্বাচল উপশহরের (দাউদপুর ও রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের আংশিক) প্রায় ১৯০০ বিঘা জমিতে শিম চাষ হয়েছে। যার বিক্রি দাঁড়াবে প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
মাইলের পর মাইল। গ্রামের পর গ্রাম। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে যে দিকে দু’চোখ যায় সে দিকেই শিমের দেখা মেলে। প্রতি বছরের মতো এবারো শিমের বাম্পার ফলনে চাষীদের মুখে হাসির ঝিলিক। রূপগঞ্জে শিম চাষের জন্য যুগ যুগ ধরে পরিচিত দাউদপুর ও রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের গ্রামগুলো। এখন পরিচিত পূর্বাচল উপশহর হিসাবে। প্রতি শীত মৌসুমে এ অঞ্চল থেকে অর্ধ শত কোটি টাকার শিম দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে রপ্তানী হয়ে থাকে। রপ্তানী হয়ে থাকে বিদেশেও। কীটনাশকবিহীন ও খাওয়ায় সু-স্বাদু হওয়ায় পূর্বাচলের শিমের কদর দেশজোড়া। শিম চাষে হাজারো কৃষক লাভবান হচ্ছে। শিম রপ্তানীর পাশাপাশি শিমের বীচির চাহিদাও কোনো অংশে কম নয়। ফলে পূর্বাচলের শিম প্রতিবছরের মতো এবারো দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস ও কৃষকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পূর্বাচলের ফেরচাইত, হাড়ারবাড়ি, গুচ্ছগ্রাম, ধামচি, কুলুপ, বাঘবের, গোয়ালপাড়া, সুলপিনা, গোবিন্দপুর, হিরনাল, বাঘলা, আগলা, কালনী, খৈশাইর, শিমুলিয়া, জিন্দা, মাধবপুর, রোহিলা, গুতিয়াবোসহ বিভিন্ন গ্রামের জমির আইল, ঢিলার পাশে, খালের পাশে, তিনশ’ ফুট সড়কের দুপাশে, বিলের পর বিল, ক্ষেতের পর ক্ষেত, গ্রামের পর গ্রাম শুধু শিম আর শিম। দেখে মনে হবে যেনো এটা শিমের সাগর। শিমের রাজ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পূর্বাচলে পুঁটি, ছুরি, ল্যাইটা, চিটাগাইংগা মডইরাসহ ৫ প্রজাতির শিমের আবাদ হয়ে থাকে। তবে চিটাগাইংগা ও ছুরি শিমের চাহিদা অন্যান্য শিমের তুলনায় অনেকটা বেশি। তাই এ শিমের চাহিদা রয়েছে দেশ জুড়ে। এ অঞ্চলে আগত পাইকাররা কৃষকদের ক্ষেত থেকে ছুরি ও চিটাগাইংগা শিম ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি হিসেবে পাইকারী দরে কিনে দেশের বিভিন্ন শহরগুলোতে ট্রাকযোগে নিয়ে যায়।
কথা হয় ৯ নং সেক্টরের বাঙাল বাড়ি সংলগ্ন শিম চাষী জহিরুল মিয়ার সঙ্গে। তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি ক্ষেত থেকে টাটকা শিম নামিয়ে এনে মাপ-ঝোক করছেন। ফসল কেমন জিজ্ঞেস করতেই ফোকলা দাঁতে হাঁসি দিয়ে জহিরুলের সোজাসাপটা উত্তর। ভাই অনেক ভালা ফলন অইছে এইবার। দেখতাছেনতো ওশি (শিম)। কতো তরতাজা। এমুন টাটকা পাওয়া যাইবোনা কোনহানে। চলতি মৌসুমে কি পরিমাণ শিম বিক্রি করবেন এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ১৫০ মণ বেচার ( বিক্রি ) আশা আছে। জহিরুল মিয়া বলেন, তিনি এবার দেড় বিঘা বর্গা জমিতে শিম চাষ করেছেন।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৩২০ হেক্টর (২৩৭১ বিঘা ) জমিতে শিম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সিংহ ভাগই পূর্বাচল উপশহরের দাউদপুর ইউনিয়ন ও রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের আংশিক এলাকায়। পূর্বাচলে এবার ২৫০ হেক্টর ( ১৮৫২ বিঘা ) জমিতে শিম চাষ হয়েছে।
দাউদপুর ইউনিয়নের ব্লকের দায়িত্বরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম, আঃ খালেক ও সাজেদা খাতুন বলেন, জহিরুল মিয়ার মতো পূর্বাচলে প্রায় এক হাজারের বেশি কৃষক মৌসুমে বিভিন্ন জাতের শিম চাষ করছেন। কথা হয় হাড়ারবাড়ি এলাকার কৃষক হাফিজুল ইসলাম, ফোরকান মিয়া, অহিদ মিয়ার সঙ্গে। তারা বলেন, এইডা আমাগো বাপ-দাদাগো আমলের পেশা। যতদিন জমি খিলা (পতিত ) পামু ততদিন আমরা তরকারী চাষ করুম। ফেরচাইত এলাকার শিম চাষী হুমায়ুন, সিরাজ ও সুরুজ। তারা তিন ভাই।
প্রত্যেকে ৩ থেকে ৪ বিঘিা জমিতে শিম চাষ করেন। এবার তাদের শিমের ফলন ভাল হয়েছে। তারা বলেন, এক মণ শিম পাইকাররা এক হাজার টাকায় কিনে নেয়। আমরা প্রত্যেক ভাই ৫শ’ থেকে ৭শ’ মণ শিম বিক্রি করি। সংসার খরচা চালিয়েও ভাল লাভ আহে। গুচ্ছগ্রামের জালাল, হেলু, মিয়াসহ কয়েকজন শিম চাষী বলেন, এহানকার শিমের চাহিদা অনেক। খাইতে স্বাদ হওয়ায় পাইকরা এই শিম কিনা নিয়া লাভ করবার পারে। উপজেলা কৃষি অফিসার তাজুল ইসলাম বলেন, রূপগঞ্জের পূর্বাচলে শীমের বাম্পার ফলন হয়।